হলজীবন: এক অদ্ভুত পরিবারের গল্প

আপলোড সময় : ২০-০২-২০২৫ ১১:৪০:৪৫ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২০-০২-২০২৫ ১১:৪০:৪৫ অপরাহ্ন
হলের আমার তলার সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা সিনিয়র-জুনিয়র ফুটবল ম্যাচ খেলব। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। কয়েকটা মেডেলেরও ব্যবস্থা করা হলো, যাতে ম্যাচের উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। মাঠে নেমেই দেখি, আমাদের হলের টিউটর এবং টেক্সটাইল বিভাগের লেকচারার অনিক স্যার পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সবাই মিলে স্যারকে অনুরোধ করলাম, ম্যাচ শেষে জয়ী ও পরাজিত দলকে মেডেল তুলে দেওয়ার জন্য। আমাদের দলে এক খেলাপাগল তো আরও এক ধাপ এগিয়ে স্যারকে ম্যাচের রেফারি হওয়ার জন্য অনুরোধ করল!

বিস্ময়ের ব্যাপার, স্যার একদমই দ্বিধা করলেন না। বরং তাঁর চোখে ফুটে উঠল এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস—হয়তো নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিগুলো এক নিমেষে ফিরে এলো। সেই সময়কার সিনিয়র-জুনিয়র ম্যাচের হাস্যরস, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আর মাঠের উন্মাদনা হয়তো এখনও স্যারের মনে দাগ কেটে আছে। তাই তিনি আমাদের ম্যাচের রেফারি হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজি হয়ে গেলেন।

আমরা যারা সিনিয়র দলে খেললাম, গত দুই বছর আগেও তো এই মাঠেই জুনিয়র দলের হয়ে খেলতাম। তখন যাদের সঙ্গে ছিলাম, তারা এখন আর নেই। আর এক বছর পর আমরাও থাকব না। আজকের জুনিয়ররা তখন সিনিয়র হবে, আর একদিন তারাও হারিয়ে যাবে সময়ের স্রোতে। হয়তো আমাদের মধ্যেই কেউ ভবিষ্যতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে, তখন তিনিও ব্যস্ততার মাঝে কোনো একদিন হঠাৎ করেই এমন একটি ম্যাচের রেফারি হয়ে যাবেন, কিংবা হয়তো নিজের ছাত্রদের সঙ্গে নেমে পড়বেন মাঠে। এ যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত সম্পর্কের অদ্ভুত বন্ধন!

এই সম্পর্ক শুধু সময়ের নয়, এই সম্পর্ক ভালোবাসার, বন্ধুত্বের, একসঙ্গে কাটানো হাজারো মুহূর্তের। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলজীবন ঠিক এমনই—যেখানে অপরিচিত মুখগুলো ধীরে ধীরে এক পরিবার হয়ে ওঠে। এখানে আছে রাতভর আড্ডা, মাঝরাতে মুড়ির আয়োজন, কার্ড-লুডুর যুদ্ধ, ছাদের ফুটবল, বারান্দায় ক্রিকেট আর পরীক্ষার আগের রাতভর নোট শেয়ার করা। প্রেমে সফলতা যেমন আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতা নিয়ে রাতভর গল্প শোনা। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কটাও এখানে অন্যরকম—কেউ বড় ভাই, কেউ ছোট ভাই, আবার কেউ বন্ধুর চেয়েও বেশি।

সবাই সবসময় একসঙ্গে থাকে, তবে পরিবারে যেমন কিছু মানুষ একাকীত্ব পছন্দ করে, এখানেও তেমন কিছু মানুষ থাকে, যারা ভিড়ের মাঝে থেকেও একা থাকতে চায়। তারা হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে না থেকেও পরিবারের অংশ। কারণ পরিবার মানে একরকম হওয়া নয়, পরিবার মানে ভিন্নতা নিয়েও একসঙ্গে থাকা।

কিন্তু সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত আসে তখন, যখন কেউ পড়াশোনা শেষ করে হল ছাড়তে যায়। চার বছর ধরে যাদের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকা, যাদের সঙ্গে রাতভর আড্ডা, খেলা, পড়াশোনা—তারা একদিন বিদায় নিয়ে চলে যায়। বিদায়ের দিন বন্ধুরা হাসতে হাসতে বলে, "ভুলে যাস না!" কিন্তু চোখের কোণে জমে ওঠে লুকোনো অশ্রু। মনে ভয় ঢুকে যায়—একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে।

তবু হলজীবনের এই সম্পর্ক কখনো ফুরায় না। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, কিন্তু হলের দেয়ালে, মাঠে, বারান্দায় রয়ে যায় সেই চিরচেনা শব্দ—আড্ডার হাসি, দুষ্টুমির শব্দ, মধ্যরাতের গানের সুর। আর বিদায় নেওয়া মানুষগুলো হয়তো কোনোদিন ফিরে এসে, মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যাবে, আর মনে মনে বলবে,
"ইশ! যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম!"

আতিকুর রহমান বাবু 
ড্যাফডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Editor & Publisher

Mehedi Hasan Limon

Address

House 22, Main Road, Block G, Banasree, Dhaka, Bangladesh 1219
Mobile : 01711-000000
Email Address : banglanewslive24@gmail.com